রহু চণ্ডালের হাড় ও আমার যাযাবরি রক্ত

Share:
রহু চণ্ডালের হাড়, অভিজিৎ সেন

‘রহু চণ্ডালের হাড়’ অভিজিৎ সেনের অসাধারণ একটা উপন্যাস। অন্তত আমি অভিভূত। এইমাত্র উপন্যাসটা শেষ করে উঠলাম তাই এখনো আচ্ছন্ন হয়ে আছি। উত্তরবঙ্গে যাদের ২০-২৫ বছর আগেও হাটে বাজারে পাড়ায় মহল্লায় দেখা যেত সেই বাজিকর সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের লড়াই নিয়ে এক মর্মান্তিক চোখে জল আনার মতো উপাখ্যান। এদের আমি প্রথম দেখেছিলাম যখন আমার চার বছর বয়স। রহু চণ্ডালের হাড় দিয়ে তারা দর্শককে সম্মোহিত করতো আর দেখাতো কখনো মজার কখনো ভয়ঙ্কর সব জাদু। আমি তখনো প্রথাগত স্কুলে যাই না। আব্বার সাথে তার একটা ভাঙাচোরা মাদরাসায় পড়তে যেতাম। তখনই ওই মাদরাসার পাশেই একদিন মোটামুটি একটা জটলা দেখলাম। শিশুর স্বভাবসুলভ ঔৎসুক্য নিয়ে গিয়ে দেখি এক ভয়ঙ্কর ঘটনা। শক্তপোক্ত এক লোকের হাতে মানুষের মাথার খুলি আর রহু চণ্ডালের হাড়। অবশ্য এগুলো আসল কি না তা বুঝার মতো বুদ্ধিজ্ঞান তখন হয়নি। সেখানে আয়োজন চলছিল এক হত্যাকাণ্ডের! লোকটি ছন্দে ছন্দে ঘোষণা দিল সঙ্গী ছেলেটির পিঠ এসপার ওসপার করা হবে ছুরি দিয়ে!! শুনে বেশ শিহরিত হচ্ছিলাম। কিন্তু সত্যি সত্যিই যখন সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটতে চললো তখন আর থাকতে পারিনি, দৌড়ে পালিয়ে গেছি আর ওমুখো হইনি। পরে আমার বোনের কাছ থেকে শুনেছি ছেলেটি নাকি মরেনি।


এই এতোবছর পর অভিজিৎ সেনের উপন্যাসটি পড়ে আবার সেই দৃশ্য স্পষ্ট ভেসে উঠছে। সেই লোকগুলোর সঙ্গে একটা অদৃশ্য যোগাযোগ অনুভব করছি। এর আগে তাদের সম্পর্কে এতোটা আমার জানা ছিল না। আর জানার আগ্রহও বোধ করিনি। অবশ্য রহু চণ্ডালের হাড় নামটার সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। আজ পুলকিত হলাম, যখন জানলাম এ হাড়ের পেছনের কাহিনীটা যেভাবে আমার মায়ের কাছে শুনেছিলাম তার একদম হুবহু। 

খুব সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে নিজেকে। অমাবস্যার রাতে জন্ম নেয়া নবজাতক ছেলে শিশু অমাবস্যার রাতেই মরে গেলে সেই অমাবস্যার অন্ধকার রহস্যময় রাতেই সেই লাশ সংগ্রহ করতে হয়। তারপর নদীর পানিতে ধুয়ে তার থেকে সংগৃহীত কণ্ঠের হাড়ই যে রহু চণ্ডালের হাড় তার প্রমাণ পেয়ে আমি অবাক হচ্ছি। এ গল্পটা সবাই জানতো। সবাই বিশ্বাসও করতো যে, এ হাড়টি দিয়ে অসাধ্য সাধন করা যায়। অভিজিৎ সেনের উপন্যাসের গল্পটা হুবহু তা-ই। এখন মনে হচ্ছে, এ সম্প্রদায়টা আমাদের সমাজ সম্প্রদায়কে দারুণভাবে প্রভাবিত করতে পেরেছে। আর তারা যে পরে অস্তিত্ব রক্ষার খাতিরে ইসলাম গ্রহণ করে মোসলমানদের সঙ্গে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করেছে তার প্রমাণ  পেয়ে গেলাম হাতেনাতে। 
  
এদের ধর্মান্তিরত করার পর নাকি নামের শেষে বাজিকর পদবীটা বাদ দিয়ে ‘মণ্ডল’ করা হয়। আমার বংশের পদবীও মণ্ডল। সুতরাং আমরা পূর্বপুরুষরা জাতপাতহীন বাজিকর ছিল কি না কে জানে! কিন্তু তারা এতো স্থাবর সম্পত্তির মালিক কেমনে হতে পেরেছিল তার হিসাব মেলাতে পারছি না। অবশ্য শেষ পর্যন্ত রাখতে পারেনি। এতে মনে হয়, সেই যাযাবরি স্বভাবটা এদের রক্তে রয়েই গেছে। তার মানে এরাই আমার পূর্ব পুরুষ! আপনি হাসছেন নিশ্চয়ই। আমি কিন্তু কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আমি এ কী আবিষ্কার করে বসলাম!
  
কিংকর্তব্যবিমূঢ় এই কারণে যে, ব্যাপারটা যদি সত্যি হয় তাহলে এখন আমার কী করা উচিৎ। আমার রক্তে যে যাযাবরি নেশা তাকেই অনুসরণ করবো নাকি আপনাদের ভাষায় সামাজিক হওয়ার চেষ্টা করবো। আমার ধারণা যদি সঠিক হয় তাহলে এখন জানতে খুব ইচ্ছে করছে এরা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী কি না। হলে সেটা আমার জন্য গর্বের। গর্ব করছি এ কারণে যে, মানুষের স্বাধীনতা ও সমঅধিকার নিয়ে আজকাল মাঠেঘাটে, টিভি ক্যামেরায়, পত্রিকার পাতায়, সভা-সেমিনারে, চায়ের কাপে যে ঝড় উঠছে তা আমরা অনেক আগে থেকেই চর্চা করে আসছি। এ সম্প্রদায়ের মধ্যে যে সামাজিক বন্ধন, ব্যক্তি স্বাধীনতা এমনকি পছন্দের পুরুষ বেছে নেয়ার যে বহুল আলোচিত 'আধুনিক নারী' অধিকার সেটাও সেখানে ছিল। এরকম কয়েকটা উদাহরণ আমার গোষ্ঠী এমনকি পরিবারেও আছে। আপনি জানলে হয়ত সেদিন থেকে আমাকে ঘেন্না করতে শুরু করবেন। তাই এখন আর বলছি না।
  
এগুলো হয়ত সেই জিনগত সুপ্ত বৈশিষ্ট্য যা একদা আমার পূর্বপুরুষদের মধ্যে ছিল। আজ আপনাদের 'আধুনিক' 'সভ্য' সমাজের মার্জিত মূল্যবোধের চাপে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়ে আছে। আমি এ কারণেই গর্বিত একই সঙ্গে উচ্ছ্বসিত।
  
কিন্তু আমার জিনে যদি এ বৈশিষ্ট্য থেকেই থাকে তাহলে কিছু আশঙ্কার কথাও না ভেবে পারছি না। এই বেপরোয়া অস্থির মানসিকতা না আবার আমাকে ছিন্নমূল করে ফেলে সে ভয় হচ্ছে। যাযাবরদের সামাজিক বন্ধন অত্যন্ত দৃঢ়। আমাদেরও ছিল বলে শুনেছি। কিন্তু প্রশ্নটা যখন অস্তিত্বের তখন এটা ধরে রাখা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। যে সম্প্রদায় সর্বদায়ই অস্তিত্ব নিয়ে শঙ্কিত তখন টিকে থাকার কৌশল নির্ধারণ নিয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব সংঘাত। যাদের কখনো কোনো শেকড় ছিল না, মাটির সাথে কোনো সম্পর্ক ছিল না তারা যখন একবার স্থাবর সম্পত্তির স্বাদ পেয়ে যায় তখন এ নেশা কাটানো প্রায় অসম্ভব। তাদের মধ্যে সেই আজন্ম লালিত ভালোবাসাটুকু থেকেই যায় কিন্তু বিত্তের বিষাক্ত লালসা এদের ক্রমেই বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। কেউ বিত্তের লোভে সবাইকে ত্যাগ করে আবার কেউ বিচ্ছিন্নতার অভিমান নিয়ে নিজেকে গুটিয়ে ফেলে।

ঠিক এরকম অনেক ঘটনা আমি ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি। চোখের সামনে কতোজন নিঃস্ব হয়ে গেল! কিন্তু সেই যাযাবরি একগুঁয়েমি, আত্মম্ভরিতা ছাড়তে পারলো না তারা। অস্তিত্ব রক্ষার দোহাই দিয়ে রক্তের সঙ্গে বেইমানি করলো। কিন্তু কারোরই শেষ রক্ষা হলো না। এর মধ্যে কেউ আপ্রাণ চেষ্টা করেছে সবাইকে আগলে রাখতে আবার কেউ নিষ্ঠুরভাবে ফায়দা লুটেছে। আমিও এই লালসা আর অভিমানের যাঁতায় পিষ্ট হচ্ছি। দুই হাতে সবাইকে আগলে রাখতে চাই, ভালোবাসতে চাই। কিন্তু ওই সেই অমোঘ বিধিতে সবাই দূরে সরে যাচ্ছে। আমি জানি তারাও আমাকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু বিবর্তন তাদের এই স্বার্থপরতা নিষ্ঠুরতার আশ্রয় নিতে বাধ্য করছে।
  
এখন আমি তাদের কাছ থেকে অনেক দূরে আছি বলে হয়ত অন্যরকম ভাবতে পারি। কিন্তু নিজেকে নিয়ে খুব ভয় হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার প্রতি কোষের জিনে সুপ্ত যাযাবরি বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকট হচ্ছে। তা না হলে, তাদের ভালোবাসি বলে কষ্ট পাচ্ছি কিন্তু কি আশ্চর্য সংসারের প্রতি কোনো মোহ খুঁজে পাচ্ছি না কেন! সংসার সম্পত্তি এখন আমার কাছে কোনো গুরুত্বই বহন করে না। এই ভয়ঙ্কর ঔদাসীন্য আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে কে জানে।

কোন মন্তব্য নেই