![]() |
| শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন ও তার ছেলে সুমন জাহিদ |
তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ুয়া নাদিয়া বলে, সুমন তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘সত্যি ট্রেন আসতেছে?’ নাদিয়া তাঁকে উত্তর দেয়, ‘হ্যাঁ সত্যি ট্রেন আসতেছে।’ ‘তখন উনি (সুমন) ওখানে শুয়ে পড়েন। আমি বলি শুয়ে পড়ছেন কেন, ওঠেন। আমি পা ধরে টান দিই। তিনি তখন আমারে লাথি মেরে ফেলে দেন সেখান থেকে। ততক্ষণে ট্রেন আইসা গেছে। আমি উইঠা দাঁড়ায় চোখ বন্ধ কইরা ফেলি। চোখ খুইলা দেখি তাঁর মাথাটা রেললাইনের মাঝে পইড়া আছে। আমি দৌড়ায়া আম্মুর কাছে গিয়ে বলি। আম্মু আইসা কাপড় দিয়ে লাশ ঢাইকা দেয়।’
নাদিয়ার মা নুরুন্নাহার বেগম বলেন, ১৫-২০ দিন ধরে তিনি ওই ব্যক্তিকে (সুমন) এই জায়গা দিয়ে চলাফেরা করতে দেখেছেন। যেই ফতুয়া ওনার গায়ে ছিল, সেই ফতুয়া গায়ে দিয়েই তিনি চলাফেরা করতেন। আরও মানুষও তাঁকে দেখেছে। যেই জায়গা লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, সেখান দিয়ে তিনি রেললাইনের এপার থেকে ওপারে যেতেন, আবার ওপার থেকে এপারে আসতেন।
গত ১৪ জুন শহীদ বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভীনের ছেলে সুমন জাহিদের দ্বিখণ্ডিত লাশ রাজধানীর খিলগাঁওয়ে বাগিচা-সংলগ্ন রেললাইন থেকে উদ্ধার করার পরদিন প্রত্যক্ষদর্শী এক শিশুর মুখে ঘটনার এমন বর্ণনাই দিয়েছেন প্রথম আলো। শিশুরটির মা নুরুন্নাহার বেগমের চায়ের দোকানটি ঠিক ঘটনাস্থলেই।
প্রথম আলোর সূত্রে আরো জানা যাচ্ছে, সুমন জাহিদ ছিলেন সদ্য দেউলিয়া হওয়া মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক মুনতাসির মামুনের ফারমার্স ব্যাংকের শান্তিনগর ব্রাঞ্চের সেকেন্ড অফিসার। সেখানে নিজের আত্মীয়স্বজনের কিছু টাকা তিনি বিনিয়োগ করছিলেন। পাঁচ মাস আগে ব্রাঞ্চটি বন্ধ হয়ে গেছে। তার চাকরিও নেই।
তবে এসব বিষয় বিবেচনায় না নিয়েই অথবা না জেনেই, সুমনের স্বজনেরা, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির লোকেরা এবং চেতনাপন্থীরা এটিকে পরিকল্পিত হত্যা বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। এর প্রধান কারণ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পলাতক দুই যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তিনি। এছাড়া এর পর থেকে তাকে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল বলে জানান স্বজনেরা। পুলিশও বিষয়টি জানত। তাঁকে নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছিল। পুলিশ তাঁকে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করার পরামর্শও দিয়েছিল। তবে সুমন জাহিদ নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে আগ্নেয়াস্ত্র বহন করতেন করতেন কি না কেউ জানে না।
এখন কথা হলো একটা পঞ্চাশোর্ধ লোক যিনি ১৯৭১ সালে মাত্র আটক বছর বয়সে পাকিস্তানি দোসরদের হাতে মাকে হারিয়েছেন, এর এতিমখানা, মাদ্রাসা, নানাবাড়ি এভাবে বহুকষ্টে বড় হলেন, সেই শহীদ সন্তান কি না ফারমার্স ব্যাংকে চাকরি নিলেন! আবার আত্মীয়স্বজনদের টাকা সেখানে বিনিয়োগও করছিলেন। ব্যাংকটি তো শুরু থেকেই ধুঁকছিল, এটা কি তিনি জানতেন না? নাকি ব্রাঞ্চের সেকেন্ড অফিসার হিসেবে ডিপোজিটের কোটা পূরণের জন্য এইটা করতে তিনি বাধ্য হয়েছেন! ব্যাংকটি দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার পর তার শান্তিনগরের শাখাটি বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে চাকরিটাও হারান তিনি। পত্রিকার খবর অনুযায়ী ফারমার্স ব্যাংকে আমানতকারীদের টাকা ফেরতের বিষয়ে সরকারও কোনো গ্যারান্টি দেয়নি। তাহলে যেই সুমন জাহিদ বড় মুখ করে আত্মীয়দের কাছ থেকে টাকা এনে তার চাকরিদাতা ব্যাংকে জমা করেছিলেন সেটির দায় তো সম্পূর্ণই তার ঘাড়ে গিয়ে পড়ে। এবার ভাবুন, একেতো চাকরি নেই, আর এই বয়সে চাকরি গেলে কী অবস্থা হয় তা সহজেই অনুমান করা যায়; বিপুল আমানতের দায়। সুমন জাহিদ কি কারো সামনে এই পাঁচ মাস মুখ দেখাতে পেরেছিলেন? এই পরিস্থিতি তাকে কতোটা ডিপ্রেসড করেছিল? তার ওপর বেকার মধ্যবয়সী এক মানুষের ঘাড়ে পরিবার প্রতিপালনের ভার!
![]() |
| মায়ের সঙ্গে সুমন |
এই পাঁচটা মাস সুমন জাহিদ কীভাবে কাটিয়েছে তার খবর কি কেউ রেখেছেন। যারা আজকে বলছেন, তিনি শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভিনের সন্তান, তিনি আত্মহত্যা করতেই পারেন না! তারা কি জানতেন এই কয়েক মাস তার মাথার উপর দিয়ে কীরকম ঝড় বয়ে গেছে? অনেকে এসব কথা বলে মন্তব্য লিখছেন, কিন্তু দেখা যাচ্ছে সুমন জাহিদ একটা বিশেষ ব্যাংকে চাকরি করতে, সেখানে আত্মীয়দের টাকা বিনিয়োগ করছিলেন, পাঁচ মাস ধরে তিনি বেকার ছিলেন- এসব কথা তারা পত্রিকার বরাত দিয়ে বলছেন। তার মানে সুমনের জীবনযন্ত্রণার কোনো খবরই তারা রাখতেন না।
নাকি তারা বলতে চাইছেন, শহীদ সন্তানদের এসব কিছুই স্পর্শ করে না, তারা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য শত ঝঞ্ঝার মধ্যেও বেঁচে থাকেন! আসলে এই চেতনাজীবীদের কাছে কখনোই জীবন স্পর্শ করে না। তারা থাকেন ঘোরের মধ্যে, সুবিধাবাদী জবনযাপন করেন আর সেই আত্মগ্লানি থেকে গরীব অসহায় শহীদ সন্তানদের কাছ থেকে আপোষহীন জীবন দাবি করেন।
আমার তো ভাবতেই অবাক লাগছে, এতোগুলো মাস সুমন জাহিদ কী করে বেঁচে ছিলেন! অবশ্য তিনি আত্মহত্যার পরিকল্পনা অনেক আগেই করেছিলেন তা প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনাতেই স্পষ্ট। ১৫-২০ দিন ধরে তিনি ওই জায়গা দিয়ে চলাফেরা করতেন। যেই ফতুয়া তার গায়ে ছিল, সেই ফতুয়া গায়ে দিয়েই তিনি চলাফেরা করতেন। যেই জায়গা লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, সেখান দিয়ে তিনি রেললাইনের এপার থেকে ওপারে যেতেন, আবার ওপার থেকে এপারে আসতেন। এই আত্মগ্লানির এই যন্ত্রণা চেতনাজীবীদের কখনোই স্পর্শ করবে না।
চেতনাজীবী বলেন, মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা কখনোই আত্মহত্যা করতে পারেন না! আমি তো মনে করি তাদের অনেক আগেই আত্মহত্যা করা উচিত ছিল! খোঁজ নিলে জানা যাবে, এরকম ঘটনা শুধু সুমন জাহিদের ক্ষেত্রেই ঘটেনি। এমন আরো অনেক মুক্তিযোদ্ধার ও তাদের সন্তানদের ক্ষেত্রে ঘটেছে। কিন্তু তারা ঢাকায় থাকেন না, হয়তো শিক্ষিতও নন, যু্দ্ধাপরাধ মামলার সাক্ষীও নন, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির লোকেরা তাদের জানেন না, চেতনাজীবীরা খোঁজ রাখেন না। হয়তো ক্ষমতাসীন দলেরই কোনো নেতার অত্যাচার, জুলুম, জমি দখল, উচ্ছেদের শিকার হয়ে শেষ পর্যন্ত আত্মাহুতি দিয়েছেন।
আচ্ছা পঁচাত্তরের পরও কীভাবে এতো মুক্তিযোদ্ধা বেঁচে থাকেন? অবশ্য আমার তো মনে হয় তারা অনেক আগেই মরে গেছেন। শেখ মুজিবকে হত্যার পর মুক্তিযোদ্ধারা কোথায় ছিলেন- যারা আজ আওয়ামী লীগের বড় ভোটব্যাংক? তারা কি পরিস্থিতিকে মেনে নিয়েছিলেন? সেই ঘটনাকে ন্যায়সঙ্গত বলে মনে করেছিলেন? তাহলে তো আজকে আওয়ামী লীগের তাদের অবস্থান মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। আচ্ছা তারা কি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন? এমনটা হলে কি তাদের আর বীর মুক্তিযোদ্ধা বলা যায়! তারা না জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন! দেশকে রক্ষা করতে কি আরেকবার খালি হাতে রাস্তায় নামার সাহসটুকুও তাদের হলো না! নাকি তারা স্বার্থের দ্বন্দ্বে অথবা লোভে এতোটা বিভক্ত হয়ে পড়েছিলেন যে দশজন মানুষ জড়ো করার মতো মনোবল বা নৈতিক অবস্থান সমাজে তাদের টিকে ছিল না! ধরে নিলাম সে এক উত্তপ্ত পরিস্থিতি। এরপরও কি কখনো কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের দেশের স্বার্থে বা কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে জীবিত মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের রাস্তায় একটা মৌন মিছিল বা মানববন্ধন করতে দেখেছেন? অথচ সরকারি চাকরিতে কোটার জন্য, চাকরিতে আবেদনের ক্ষেত্রে তাদের বয়সসীমা বাড়ানোর জন্য, নিয়োগ পরীক্ষা তাদের জন্য সহজ করার জন্য, ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে ঠিকই ব্যানার হাতে রাস্তায় নেমে পড়েন। অথচ স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর এসে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রস্তুত নিয়ে এতো কেলেঙ্কারির পরও তারা নির্বিকার। আর বীরঙ্গনাদের অবমূল্যায়নের কথা নাই বা বললাম! এই হলো চেতনার হাল!
যাই হোক, সুমন জাহিদ একজন শহীদ সন্তান। কিন্তু অন্য ক্ষমতালগ্ন শহীদ সন্তানদের মতো সুযোগ সুবিধার ছিঁটেফোঁটাও তিনি পাননি। এই দেশের আর দশটা সাধারণ এতিমের মতো করেই তিনি বড় হয়েছেন। আর দশটা নিম্নমধ্যবিত্ত বাংলাদেশীর মতোই টানাটানির সংসার নিয়ে তার একটা জীবন ছিল। চাকরি বাঁচাতে ইনসুরেন্স কোম্পানির এজেন্টের মতো তাকেও আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ডিপোজিটের টাকা জোগার করে কোটা পূরণ করতে হয়েছে। চেতনাজীবীদের যেই ব্যাংকে তিনি শেষ বয়সে একটা চাকরি জুটিয়েছিলেন, সেই চেতনাজীবীরাই তার চাকরিটা খেয়েছে। পাকিস্তান তার মাকে হত্যা করেছিল, যখন তার বয়স আট বছর আর পঞ্চাশ বছর বয়সে তাকে হত্যা করলো স্বাধীন বাংলাদেশ!


কোন মন্তব্য নেই