![]() |
| নিজেকে হিন্দু অভিশ্রুতি পরিচয় দেওয়া বৃষ্টি খাতুন |
দুনিয়ার শাসকেরা এখন অনেক চালাক, টিসিবির ট্রাকে লাফিং গ্যাস বেচে। বোকা পাবলিক হাসতে হাসতে বুকে খিল লেগে মরে যায়। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে দেখানো হয় হার্টঅ্যাটাক অথবা আত্মহত্যা। বৃহৎ পরিসংখ্যান বড় জোর বিবেকের তাড়না অথবা অসন্তোষের শঙ্কা জাগায়, তাই বণ্টিত হয় কাগজে ছাপা আনুষ্ঠানিক শোক। বহু হম্বতম্বির পর শেষ বিচারে কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়!
ওদিকে ইশ্বরের প্রতিশ্রুত ভূমিতে রক্তের বন্যায় প্রমোদতরী ভাসিয়ে দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্রের ধ্বজা উড়িয়ে চলেছে এক সম্প্রদায়। ত্রাণের জন্য হাত বাড়ানো বুভূক্ষু শিশুর বুক এফোঁড় ওফোড় করে দিচ্ছে বোমার শার্পনেল অথবা আকাশ থেকে ছুটে আসা বুলেট। অপরাধবোধ আত্মাহুতির উসকানি দিচ্ছে অ্যারল বুশনেলদের। দেশে দেশে বিক্ষোভ। শাসকদের বিরুদ্ধে বিরক্তি উৎপাদন করে চলেছে বেয়াড়া তরুণেরা।
এর মধ্যেই বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য করছে ইরাস ট্যুর। লাইভ কনসার্টে ভক্তদের উল্লাসে ভূমি কাঁপছে। রাতারাতি বিলিয়নিয়ার বনে যাচ্ছে কোনো আধুনিক বাইজি। কোটি কোটি অভুক্তের দেশে বিদেশি বাইজি এনে প্রাক বিবাহ অনুষ্ঠানে নাচানো চলছে, কয়েক হাজার পদে রসনা বিলাস। পত্রিকার পাতাজুড়ে রঙিন ছবি। কারা এলো, কারা নাচল, পেট ভর্তি বাচ্চাও কাকে মঞ্চে কোমর দোলানো থেকে নিবৃত্ত করতে পারল না- সেসবের আদ্যোপান্ত নিয়ে ব্যস্ত মিডিয়া।
আর দেশে, মর্গে লাশ রেখে লাইভ কনসার্টে চলছে উদ্দাম, উল্লাস। ডলার সংকটে আমদানি সংকোচনের সময়ে বিদেশি শিল্পী এনে চলছে কনসার্ট। জনপ্রিয় দেশীয় ব্যান্ড মাতাচ্ছে বন্দরনগরী। মিরপুরের মাঠ কাঁপাচ্ছে ভাড়াটে খেলোয়াড়েরা। টেলিভিশন আর মোবাইল স্ক্রিনে মুখ গুঁজে ভেতরে ভেতরে আনন্দ আর উত্তেজনায় কাঁপছে দুনিয়ার তাবৎ বিষয়ে অনাআগ্রহী ক্রীড়াপ্রেমীরা।
আরেক দিকে লেগে গেছে দুই গোষ্ঠীর কাইজ্যা। ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তড়পাতে তড়পাতে মরে যাওয়া সেই তরুণীর লাশ পড়ে আছে মর্গে। কাদের বিশ্বাস জিতবে সেই কাইজ্যার মধ্যে হিমঘরে মুখ গুঁজে আরও কিছু দিন তাকে দেখে যেতে হবে তার জীবদ্দশার দমবন্ধ পৃথিবী। যে মেয়েটি হয়তো কোনো এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে পালাতে চেয়েছিল। দিকভ্রান্ত হয়ে নূপুর ভেবে পায়ে পরেছিল আরেক শিকল।
আসলে তার লাশের দায়িত্ব দুই গোষ্ঠীর কেউ-ই নিতে রাজি হয়। আসলে তারা চায় জিততে। ওদিকে সন্তানের অকাল মৃত্যুতে মায়ের বুক ভেসে যায়। শেষবার তাজা মুখটাও আর দেখার সাধ মিটবে না তাঁর।
এই মৃত্যুর দায় কার? এ নিয়ে চলছে অনেক জ্ঞানগর্ভ স্ট্যাটাস প্রসবের প্রতিযোগিতা। ফুড ভ্লগারদের রেস্টুরেন্টের ফায়ার সেফটি নিয়েও কথা বলা উচিত কি না এ নিয়ে চলছে তুমুল তরজা। মাঝখান থেকে কর্তৃপক্ষ দায়ী নয় গোছের একটা পরিণতির দিকেই এগোচ্ছে আয়োজন।
যেমন, টেলর সুইফটের এশিয়া ট্যুর নিয়ে লেগে গেছে সিঙ্গাপুর আর ফিলিপাইন। ইরোটিক ইরাস ট্যুরের রাজস্ব সম্ভাবনা কেউ হাতছাড়া করতে রাজি নয়।
সব দেশেই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকট ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। বাড়ছে বিনোদন ব্যবসা। সোশ্যাল মিডিয়াতে মনোরঞ্জন ব্যবসা এখন রমরমা। লোক হাসিয়ে মাসে এক হাজার ডলার কামানো ইনফ্লুয়েন্সারদের নিয়ে সম্মেলন করেন এদেশের এমপি-মন্ত্রীরা। সোশ্যাল মিডিয়া সেলিব্রিটি থেকে হওয়া যায় জনপ্রতিনিধি। ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণে ঘাম ছুটে যায় কিন্তু বিদেশি শিল্পীদের আনাগোনা থামে না। বিপ্লবী ব্যান্ড দলগুলো সেই মওকা লুফে নেয়, বহুদিন কনসার্টের খরায় থাকা পারফর্মারেরা খ্যাপ মারার লোভ সামলাতে পারে না।
এই উন্মাতাল আনন্দ আয়োজন আর সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেকে জাহির করা, জ্ঞানী প্রমাণের প্রতিযোগিতা, কখনো আমাদের বাস্তব প্রয়োজনের ওপর মনোযোগ নিবদ্ধ করতে দেবে না। সেই সঙ্গে ব্যর্থ বিপ্লবীদের পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের (রাজনৈতিক শুদ্ধতা) বয়ান তত্ত্বের ফাঁদে বুদ্ধিবৃত্তিক বিলাসিতার লোভ দেখায়। এই বহুমাত্রিক নিয়ন্ত্রণের যুগে এমন চর্চা ও প্রবণতায় যারপরনাই খুশি দণ্ডধারীরা।
শুধু ঘরে-বাইরে, রাস্তার মোড়ে, হাতের মুঠোয় ঠাসা ডিভাইসে ঘাপটি মেরে থাকা নীল ক্যামেরার চোখ দিয়ে আর হচ্ছে না; 'প্রত্যেকে মোরা পরের তরে' শিশুকালের অতি নিরীহ উপদেশমূলক এই আপ্তবাক্য পুঁজি করে 'আনন্দ আয়োজনের ভেতর দিয়ে নাগরিক নিয়ন্ত্রণ'-এর কৌশল বেশ রপ্ত করেছেন তাঁরা। অরওয়েল আর হাক্সলি দুটোই গুলিয়ে খেয়েছেন আধুনিক শাসকেরা। বরাবরের মতো পাবলিক বেখেয়াল!

কোন মন্তব্য নেই